মায়াজম : যেভাবে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় কাজে লাগানো হয়

মায়াজমকে আমরা কিভাবে কাজে লাগাবো এবং কেনই বা সিফিলিটিক রোগী হয়েও একজন সিফিলিটিক ঔষধ ছাড়া আরোগ্য হলো তার-ই প্রমান দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে, লক্ষণই কেবল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার মূল হাতিয়ার।

নিম্নের একটি রোগীতত্ত্বই এর প্রমান দেবে :

রোগীর বয়স – ৫৬ বৎসর। তিনি তীব্র মাথাব্যাথার জন্যে আমার কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। রাত্রি ১২ টা, ১ টার দিকে রোগীর ঘুমের মাঝে প্রচন্ড মাথাব্যাথা হয়। রোগীর ভাষ্য অনুযায়ী ঘুমের মাঝে হঠাৎ করে তাঁর যে পাশে তিনি কাৎ হয়ে শুয়ে থাকেন তার উপর পাশের মাথা হতে একটি টেনিস বলের মতো গোল একটি  বল নীচের দিকে গড়িয়ে নেমে আসে, আর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠেন। মাথায় তখন হাত দিয়ে চেপে ধরতে হয়। বেশ কিছুক্ষণ পর রোগী আবার শুতে গেলে, তখন সে পাশ পাল্টিয়ে শোয়; কিন্তু ঐ একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এভাবে রোগী ১০ বৎসর যাবৎ যন্ত্রণা সহ্য করে আসছে এবং প্রতিদিন ২/৩ বার করে মাথার যন্ত্রণার জন্যে ট্যাবলেট খেয়ে আসছেন।কোনো কোনো দিন রোগী মাঝ রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে বেশ অনেক্ষণ গোসল করার পর শরীর ঠান্ডা হলে আরাম বোধ করেন। সকালেও ঘুম থেকে উঠার পরও মাথাব্যাথা হয়, সারা দিনই থাকে; তবে তা রাত্রির মাথাব্যাথার মতো নয়। রাত্রিতে শোয়ার পর মাঝে মধ্যে পা জ্বালা করে। অন্য কোনো সমস্যা নেই। তবে ২০ বৎসর পূর্বে রোগীর সিফিলিস হয়েছিল। 

এখনো লিংঙ্গের ডগার মাঝে একটি গোলাকার গর্তের মতো দাগ হয়ে আছে।রোগীর শরীরে আঁচিল হওয়ার ইতিহাসও আছে এবং সে গুলো রোগী চুল দিয়ে বেঁধে কেটে ফেলে দেয়। বংশগত ভাবে মায়ের আলসারের সমস্যা (হোমিও খেয়ে এখন ভালো) ছাড়া আর কারো কোনো বড় ধরণের রোগের ইতিহাস নেই।

যে যে লক্ষণের উপর ভিত্তি করে ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছে তা নিম্নরূপ :

প্রথমেই রোগীর মুখের দিকে চেয়ে দেখি বিষন্নতা মাখা মুখের মাঝে এক চিলতে অকারণ মুচকি হাসির আনাগোনা। 

রোগী গরমকাতর। রোদ্র সহ্য হয়না । রোগী সর্বদাই ছায়ার মাঝে থাকতে চায়।

শীত-গ্রীষ্ম, কোনো সময়েই গোসল না করে থাকতে পারেনা। 

প্রচুর লবন খাওয়ার ইতিহাস আছে। সব খাদ্যই পছন্দ, তবে দুটোর বেশী রুটি খেলে বুক জ্বালা করে। পিপাসা ভলোই হয়। 

পূর্বে ভীষণ রাগী ছিল। এখন মানিয়ে নিতে পারেন। কিন্তু কারো সঙ্গে অসদাচরণের ঘটনা ঘটলে তা সহজে মন থেকে মুছে যায় না। 

প্রকাশ্যে লোকালয়ে বা রাস্তার ধারে প্রস্রাব করতে ভীষণ লজ্জ্বা বোধ হয়। 

আমি উপরোক্ত লক্ষণের সমন্বয়ে নেট্রাম মিউর দেয়ার আগে প্রথমে সালফার ৩০ প্রয়োগ করি। সালফার প্রয়োগ করি এজন্যে যে, এলোপ্যাথিক ঔষধকে এন্টিডোট করার জন্যে। তবে তা করেছি রাত্রিতে পা জ্বালার কথা বিবেচনা করে। যাহোক্ সালফার প্রয়োগ করার পর ৪/৫ দিন ভালো থেকে যখন ব্যাথা আবার দেখা দেয় তখন আরো দুদিন অপেক্ষা করে মাথাব্যাথার আর কোনো উন্নতি নাহলে নেট্রাম মিউর 1M প্রয়োগ করি এবং এখন পর্যন্ত রোগী সুস্থ অবস্থায় আছে।

মায়াজমকে কাজে লাগানোর কৌশল :

এখানে নেট্রাম একটি এন্টিসোরিক, এন্টিসাইকোটিক ও এন্টিটিউবারকুলার ঔষধ হয়েও কেন সিফিলিটিক এই রোগীকে আরোগ্য এনে দিলো তা যদি বিচার বিশ্লেষণ করে দেখি, তবে অকপটে বলতে হয় লক্ষণ হলো কোনো রোগীর আপন সত্তার প্রয়োজনীয় ঔষধ প্রার্থনার জন্যে তাঁরই জীবনীশক্তির ভাষা। এখানে কোনো মিথ্যাচার থাকেনা। তাহলে কি মায়াজমের কোনো প্রভাব বা প্রয়োজন নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে সেটি বিবেচনায় আনার কিছু কৌশলও আছে। 

যেমন, যদি এমন এক সময় আসে এবং দেখা যায় পূর্বোক্ত লক্ষণ গুলো আবারও ফিরে এসেছে, তখন পুনরায় নেট্রাম দিয়েও আর কাজ হচ্ছেনা, তবেই কেবল চিন্তা করতে হবে মায়াজম সম্পর্কে। না খেলে বড়শি দিয়ে যেমন বড় বড় রুই-কাতলা পানি থেকে তুলে আনা যায়না, তেমনি প্রথমতঃ জীবনীশক্তি যেভাবে চায় সেভাবে অগ্রসর না হলে রোগকেও দেহ থেকে সরিয়ে আনা যায়না। বড়শি দিয়ে খেলার শেষে যেমন বড় মাছটি তুলে আনতে খাঁচা জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে হয়; তেমনি উপযুক্ত ঔষধ প্রয়োগ সত্ত্বেও যখন রোগ নির্মূল হতে চায়না,তখনই কেবল মায়াজম নামীয় খাঁচাটি ব্যবহার করে যে ধরনের মায়াজমেটিক অবস্থা রোগী দেহে বিরাজ করে তৎসদৃশ্যে একটি এন্টি-মায়াজমেটিক ঔষধ প্রয়োগ করে রোগীর নির্মল আরোগ্য ফিরিয়ে আনতে হয়। এখানে এ রোগীর বেলায় সিফিলিটিক মায়াজমের অস্তিত্ব বিরাজমান। তবুও অপেক্ষায় থাকতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না জীবনীশক্তির সিগন্যাল আসে, অর্থাৎ রোগীর পূর্বোক্ত লক্ষণ যদি ফিরেই না আসে তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতেই হবে; আর যদি ফিরে আসে তবে এ রোগীর বেলায় একটি এন্টি-সিফিলিটিক ঔষধ হিসেবে সিফিলিনামই প্রয়োগ করার ইচ্ছে রইলো। আরও একটি কথা, যদি পূ্র্বোক্ত লক্ষণ গুলো রোগীর না ফিরে বা অন্য কোনো ঔষধের চিত্র ফুটে উঠে, তবে সে চিত্র অনুযায়ীই ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। 

এখানে এ রোগীর বেলায় থুজা ঔষধটিরও একটি সম্ভাব্য চিত্র আছে। এমনও হতে পারে থুজার চিত্রই ফুটে উঠলো, তখন অবশ্যই থুজা প্রয়োগ করতে হবে এবং সে সিগন্যালটা হয়তো কতগুলো আঁচিল নিয়ে প্রকাশিত হতে পারে। যাহোক্, অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা। তারপরও কথা হলো সিফিলিনাম প্রয়োজন হলেও হতে পারে বা এমনও হতে পারে যে, সিফিলিনামের লক্ষণ আর আসলোই না। না আসলে করারও কিছু থাকবেনা। 

আবার এই রোগীর ৬০ বৎসর বয়সে একদম নির্মল আরোগ্যও আশাকরা দূরাশা মাত্র। তবে এই বয়সে অন্যান্য প্যথি অপেক্ষা রোগীকে বেশী ভালো রাখা যাবে। আরও একটি কথা হলো, এই রোগীর আদ্যক্ষত ফিরিয়ে আনতে না পারলে রোগী হিসেবে আরোগ্য হয়েছে বলা যাবেনা। 

মন্তব্য : যদি আমি রোগীর লক্ষণ বাদ দিয়ে রোগের লক্ষণের দিকে তাকাতাম, তবে আমাকে মধ্যরাত্রে বৃদ্ধির জন্য আর্সেনিক ও ঘুমের মধ্যে রোগ লক্ষণের বৃদ্ধির জন্য ল্যাকেসিস এবং সিফিলিটিক এটাক হওয়ার ইতিহাসের জন্যে সিফিলিনাম ঔষধ গুলো নিয়ে ধাঁধায় পড়তে হতো। 

 এটাও ঠিক যে, রোগ লক্ষণের কৌশল সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে ধাঁধায় পড়া স্বাভাবিক এবং ঔষধ প্রয়োগেও জটিলতা দেখা দিত। সুতরাং সবচেয়ে বড় কথা হলো একটি সিফিলিটিক মায়াজমের রোগী একটি নন-সিফিলিটিক ঔষধ নেট্রাম মিউর  দ্বারা আরোগ্য হয়ে গেল। তবে অপেক্ষায় আছি মেজ গুলো ফিরে আসে কি-না ? 

আসলে থুজা প্রয়োগ করবো, যদি না-ও আসে তবুও থুজা প্রয়োগ করবো, অবশ্যি দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর। আবার এই থুজার মাঝেও দেখা যায় যে, তার তিনটি মায়াজমের উপরই কাজ করার ক্ষমতা আছে। যাহোক্ লক্ষণ বিবেচনায় থুজা, সিফিলিনাম বা অন্য কোনো ঔষধ প্রয়োজনানুসারে প্রয়োগ করার ইচ্ছে রইলো। মনে রাখতে হবে লক্ষণ প্রকৃতির ভাষা এবং আমাদেরকে রোগীর লক্ষণ অনুযায়ীই কার্য সমাধা করতে হবে।   

 ঔষধ প্রয়োগ পদ্ধতি : আমি সব রোগীদের ক্ষেত্রেই ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ হলে একটি পোস্তদানার ন্যায় ঔষধবটিকা, নয়তো শততমিক ঔষধ হলে একটি ২০ নং গ্লোবিউলের একটি বটিকা ২ ড্রাম শিশিতে, নয়তো এক আঃ ফাইলে পানির সাথে মিশিয়ে ঐ মিশ্রণ হতে ৪/৫ ফোঁটা ঔষধ কিংবা ২ ড্রাম শিশি হলে ২/৩ ফোঁটা ঔষধ ২/৩ দিন প্রাতে একবার করে প্রথমদিন এক ঝাঁকি ও দ্বিতীয় দিন থেকে দশ ঝাঁকি দিয়ে খেতে দিয়ে ঔষধ বন্ধ  করে দেই। আর এক আঃ এর বেলায়ও ঐ একই নিয়মে ১০ টি ঝাঁকি দিয়ে খেতে দেই। প্রয়োজনে কাপিং পদ্ধতিই অনুসরণ করি।


লেখক :

ডা. এ.বি.এম শহীদল্লাহ্ 

ডিএইচএমএস(বিএইচবি-ঢাকা)

ক্লাসিকাল হোমিওপ্যাথ

চেম্বারঃ- ওহি হোমিও কেয়ার

১৪৭ পূর্ব আজমপুর, উত্তরা, ঢাকা।

(চালবান ভাই ভাই মার্কেট গলি দিয়ে ভেতরে ঢুকে মুন্সিবাড়ি মোড়)

Next Post Previous Post