হোমিওপ্যাথি’র মাইন্ড ম্যাথডের স্বরূপ

 

মাইন্ড ম্যাথডের স্বরূপ কী? হোমিওপ্যাথি না-কি হোমিওপ্যাথির মধ্যেই মাইন্ড সিম্পটমস? 

শুরুতেই বলি মাইন্ড ম্যাথড আর মাইন্ড সিম্পটমস আসমান-জমিন পার্থক্য বিদ্যমান। আমরা মাইন্ড সিম্পটমস কে অস্বীকার করিনা বরং গুরুত্ব সহকারেই গ্রহণ করি। তবে মাইন্ড ম্যাথড বা মাইন্ডপ্যাথিকে অস্বীকার করতেই হবে, কেননা ইহা একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। আর হোমিওপ্যাথি ও মাইন্ডপ্যাথি দু'টি চিকিৎসা পদ্ধতিতে আলাদা স্বতন্ত্র স্বকীয়তা বিরাজমান।

প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতির যেমন আলাদা স্বকীয়তা রয়েছে, ঠিক তেমনি মাইন্ড ম্যাথডের ও আলাদা স্বতন্ত্র স্বকীয়তা বিদ্যমান। যা কোন ভাবেই হোমিওপ্যাথি বা সদৃশ চিকিৎসা পদ্ধতি নয়। বরং হোমিওপ্যাথির নামে চালানো একটি নব-আবিষ্কৃত পদ্ধতি। যা হোমিওপ্যাথির স্রষ্টা ডা. হ্যানিম্যানের পরিপূর্ণ অর্গানন অভ্ মেডিসিনের সাথে সাংঘর্ষিক বিষয়। এমনকি Mathod এর অর্থ অক্সফোর্ড ডিকশনারীতে নিয়ম শৃঙ্খলা, পদ্ধতি নামে পরিচায়িত করা হয়েছে।

আংশিক ভাবে অর্গাননের একটি সুত্রে (২১৩ নং) ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান মাইন্ড সিম্পটমসের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। যা সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতিরই একটি আবশ্যকীয় অংশ। কিন্তু সেই অংশকে আলাদা ভাবে একটি স্বতন্ত্র স্বকীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করা কোন ভাবেই অনুমদিত নয়। বরং উক্ত সুত্রে  ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান  সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতিকে একটি পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা পদ্ধতি রুপে তুলে ধরার জন্যই মাইন্ড সিম্পটমস এর গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

প্রসঙ্গে আসতে পারে যে,  "দেহকে চালিত করে হরমোন সিস্টেম ও নার্ভাস সিস্টেম। সমস্ত দেহকে কন্ট্রোল করে ব্রেইন"

এই যুক্তিটি কখনোই সঠিক যুক্তি নয়, আর হোমিওপ্যাথি এই সকল অসাড় যুক্তি থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত। আর এই যুক্তি গুলো বিসদৃশ চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে মানায়। কিন্তু হোমিওপ্যাথি এই অসাড় যুক্তিকে কখনোই সমর্থন করে না। যদি তাই হতো তাহলে এলোপ্যাথি, এন্টিপ্যাথি ও আইসোপ্যাথিতে এরকম হাজারো যুক্তি রয়েছে। যা ডা. হ্যানিম্যান অপ্রয়োজনীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর তিনি প্রমান করেছেন যে (অর্গাননের ৯, ১০, ১১ নং সূত্রে) একটি সুস্থ দেহের চালিকাশক্তি হচ্ছে জীবনীশক্তি বা ভাইটাল ফোর্স। আর এই Vital Force বা জীবনীশক্তিই জীবন্ত দেহের অদৃশ্য অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ব করে। যেমন রোগ প্রতিরোধ করা, রোগাক্রান্ত হওয়া, রোগযন্ত্রনা হওয়া এছাড়া রোগ লক্ষণ প্রকাশ করা। এমনকি ইন্দ্রীয় সমূহের মাধ্যমে অনুভূতি গ্রহণ করা, রোগ আরোগ্য করা, ইত্যাদি জীবনীশক্তির প্রধান কাজ। আর এই জীবনীশক্তি ততদিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকবে যতদিন আত্মা বা রুহ দেহে বিদ্যমান থাকবে। (তবে এর খন্ডিত অংশগুলো ৬ ঘন্টা পর্যন্ত সক্রিয় থাকে) আর এজন্যই ডা. কেন্ট বলেছেন, রুহ হলো জীবনীশক্তির Vice-regent বা উপরাজ। 

এবার আসুন অর্গনন অভ্ মেডিসিনের (৯, ১০, ১১) সূত্রানুযায়ী, ডা. কেন্টের কোর্টেশন অনুযায়ী এবং এর ব্যাখ্যাকারক আন্তর্জাতিক হোমিওপ্যাথিক গবেষক, বাংলায় হোমিওপ্যাথির স্বরুপ উন্মোচনকারী লেখক ডা. রেজাউল করিম স্যারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সম্পূর্ণ দেহের  নিয়ন্ত্রণের জন্য কে দায়ী? ব্রেইনের নার্ভাস সিস্টেম! না-কি জীবনীশক্তি! যার উপরাজ হচ্ছে রুহ বা আত্না। অবশ্যই এই কাজটি জীবনীশক্তির, যা ইতিমধ্যেই আমি প্রমান করে দিয়েছি। আর যদি তাই না হতো" তাহলে যার ব্রেইন অসুস্থ বা পাগল সেই ব্যাক্তিকে কিভাবে আপনি চিকিৎসা প্রদান করছেন? আর সে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে! তার তো ব্রেইনের নার্ভাস সিস্টেম অক্যাজো? 

একটা উদাহরণ দিয়ে দেহ পরিচালনার কাজটি কার প্রমান করা যায়। যেহেতু আমি একজন ক্যামিস্ট্রির ছাত্র সেই হিসেবে উদাহরণ টা দিচ্ছি। জীবন্ত দেহে জীবনীশক্তি সক্রিয় থাকার কারণে নাইট্রিক এসিড HNO3 অথবা  ক্রিয়জোটের মূল উপাদান অক্রিওসল জীবন্ত দেহের কোন অংশে স্পর্শ করলে সেই অংশ পচে যাবে বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে (জীবনীশক্তির কারণে)। 

অপর দিকে একই উপাদান গুলো নাইট্রিক এসিড HNO3 অথবা অক্রিওসল মৃতব্যাক্তির দেহে ভালো ভাবে লাগিয়ে দিলে, দেহটি পচন মুক্ত থাকবে অর্থাৎ সংরক্ষিত থাকবে (জীবনীশক্তির কারণেই)। একই দেহে একই কেমিক্যালের পরসস্পর দুই কাজই প্রমান করে যে, জীবনীশক্তিই দেহকে পরিচালিত করে।  

যারা মাইন্ড ম্যাথডকে হোমিওপ্যাথি নামে চালাতে চান তাদের কাছে আমার প্রশ্ন? আশা করছি জেনে বুঝে সঠিকভাবে উত্তর প্রদান করবেন।

ক) মাইন্ড ম্যাথডের মধ্যে হোমিওপ্যাথি নাকি হোমিওপ্যাথি বা সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতির মধ্যে মাইন্ড সিম্পটমস?

খ) আপনারা নিজেই যেটাকে আলাদা ম্যাথড নামে অভিহিত করছেন, সেটাকে ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের আবিষ্কৃত হোমিওপ্যাথি নামে চালাচ্ছেন এটা কি স্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ হচ্ছেনা? যেখানে ম্যাথডই হলো একটি স্বতন্ত্র স্বকীয় পদ্ধতি।

গ) আপনারা কি ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের লিখিত হোমিওপ্যাথির মৌলিক পুস্তক অর্গানন অভ্ মেডিসিনের সামগ্রিক ভাবে (২৯১ টি সুত্রের) মাধ্যমে মাইন্ড ম্যাথডকে ডা. হ্যানিম্যান সীকৃতি দিয়েছেন, উহা প্রমান করতে পারবেন?

ঘ) হোমিওপ্যাথির স্রষ্টা ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান সহ এবং অনুসরণ যোগ্য সকল চিকিৎসক যেমন ডা. কেন্ট, ডা, হ্যারিং সহ ডা লিপি প্রত্যেকেই সার্বদাহ্যিক লক্ষণ নিয়ে অর্থাৎ লক্ষণ সমষ্টির মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করেছেন এবং এটিই হোমিওপ্যাথি বা সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতি। যদি এমনই হতো যে মাইন্ড সিম্পটমস দিয়েই রোগীর সকল লক্ষণ অপসারণ হতো, তাহলে কেন তারা অন্য সকল লক্ষণ সংগ্রহ করলেন এবং কেনই বা ডা. কেন্ট রেপার্টরীতে ৩৭টি আলাদা আলাদা অধ্যায়ে বিন্যাস করলেন? 

ঙ) আর কেনই বা ডা স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তার নিজ দেহে ঔষধ প্রুভিং করার সময় মেটরিয়া মেডিকায় কেন শারীরিক, মানসিক ও সার্বদৈহ্যিক সকল লক্ষণ লিপিবদ্ধ করলেন? যেখানে শুধুই মানসিক লক্ষণই ঔষধ নির্বাচনের জন্য যথেষ্ট ছিলো (মাইন্ড ম্যাথডের থিউরি অনুযায়ী)?   

চ)  অর্গাননে ঔষধের কার্যকারিতার ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত দেওয়া হয়েছে আর তা হচ্ছে সদৃশ হতে হবে। অর্থাৎ যে ঔষধ সুস্থ দেহে প্রুভ করার সময় যে লক্ষনগুলো উৎপন্ন করতে পারে, কেবল সেই সদৃশ লক্ষণগুলোই সে অপসারণ করতে পারে। অন্য লক্ষণ সে অপসারণ করতে পারেনা। তাহলে পডোফাইলাম প্রুভ করে যে লক্ষণ উৎপন্ন হয়েছে, সেই লক্ষণ কিভাবে বেলাডোনা অথবা স্টোমিনিয়াম, হায়োসিয়ামাস প্রয়োগে দূরীভূত হবে?

পরিশেষে বলতে চাই ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান তার লেসার রাইটিংসে বলেছেন, যারা হোমিওপ্যাথি বা সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতি বুঝেনা তারাই অন্য প্যাথি অনুসন্ধান করে। 

হাতির একটি অঙ্গ যেমন সম্পূর্ণ হাতি নয়, কিন্তু হাতির একটি অংশ বিশেষ। তেমনি মাইন্ড সিম্পটমস হোমিওপ্যাথিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিম্পটমস কিন্তু পরিপূর্ণ হোমিওপ্যাথি বা সদৃশচিকিৎসাপদ্ধতি নয়।


লেখকঃ-

ডা. এম বখতিয়ার রহমান

বিএসসি (অনার্স) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ডিএইচএমএস (বিএইচবি) ঢাকা

সিইও- হ্যালো হোমিওপ্যাথি

Next Post Previous Post