রোগীকে প্রেসক্রিপশন প্রদানে ডা. হ্যানিম্যানের দিকনির্দেশনা

রোগীকে প্রেসক্রিপশন প্রদানের বিষয়ে ডা. হ্যানিম্যানের দিকনির্দেশনা কী? 

আলোচনায় : আন্তর্জাতিক হোমিওপ্যাথিক গবেষক ও লেখক, উপমহাদেশের অন্যতম হোমিওপ্যাথিক শিক্ষাগুরু, ৫০ বছরের অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ, ডা. রেজাউল করিম। 

প্রিয় হোমিও সমাজ লক্ষ্য করুণ! 

এক শ্রেণির হোমিওপ্যাথ বলে থাকেন যে, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকগণ রোগীকে লিখিত Prescription দেন। কিন্তু হোমিওপ্যাথিতে তা দেওয়া হয় না কেন? এর জবাব আমরা মহাত্মা হ্যানিম্যানের মাধ্যমেই দিতে চাই। মহাত্মা হ্যানিম্যান তার দি লেসার রাইটিংস্ পুস্তকের শেষ অধ্যায়ে দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি রোগীলিপি দিয়েছেন। প্রত্যেক রোগীকে তিনি সেবন বিধির নির্দেশসহ নিজে ঔষধ দিয়েছেন। কোনো রোগীকে ঔষধ লিখে দেননি। ডা. ডানহাম তার মেটেরিয়া মেডিকায় হ্যানিম্যানের একটি রোগীর বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে যে, ডা. হার্টমান জানিয়েছেন যে, “মহাত্মা হ্যানিম্যানের কাছে চিকিৎসার জন্য একজন রোগী আসে। রোগটি ছিল গুহ্যদ্বারে Condylomata (Figwarts)। হ্যানিম্যান শ্লেষ্মাগুটিগুলো পরীক্ষা করেন এবং আধা ঘণ্টা পর্যন্ত রোগীকে জেরা করেন এবং তার রেকর্ড বহিতে লক্ষণগুলো লিখেন। তারপর তার রেকর্ড বইটি বন্ধ করেন এবং কিছুক্ষণ পর্যন্ত মেটেরিয়া মেডিকা পর্যালোচনা করে পাশের কক্ষে গিয়ে তিনটি পুরিয়া নিয়ে আসেন এবং বলেন যে, তিন দিন পর পর সেবন করবে; পুনরায় চৌদ্দদিন পর আসবে; #এখন আমাকে চার ডলার দাও। লোকটি তা পরিশোধ করে এবং চলে যায়।" হ্যানিম্যান

রোগীকে ঔষধের নাম লিখে দেন নি। "Prescription and dispensing of Medicine by the Homoeopathic physician" শিরোনামে হ্যানিম্যান তার দি লেসার রাইটিংস পুস্তকের ৬৯৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন যে, “সাধারণ চিকিৎসাকলার সাথে আমার চিকিৎসাপদ্ধতির কোনো মিল নেই, অধিকন্তু সকল ক্ষেত্রে এর যথার্থ বিপরীত। এটি এমন একটি নতুন (আধুনিক) ব্যবস্থা যার ক্ষেত্রে ঔষধ পরিবেশনের এতকাল যাবৎ প্রযোজ্য পরিমাপের মানদন্ড সম্পূর্ণ অনুপযোগী।

"Aesculapius in the balance" শিরোনামে হ্যানিম্যান তার দি লেসার রাইটিংস পুস্তকের ৪৩৩ পৃষ্ঠায় পাদটীকায় বলেছেন যে, যথার্থই বলা হয় যে, এ চিকিৎসাকার্য একটি চুক্তি যা রোগী শুধুমাত্র চিকিৎসকের সাথেই করে। মৌখিকভাবেই তা করা হয়। চিকিৎসক তার সহায়তা এবং উত্তমভাবে প্রস্তুতকৃত কার্যকর ঔষধ দিতে ধর্মতঃ প্রতিশ্রুতি দেন একটি প্রতিজ্ঞা যা, কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে কাউকে দিয়ে করানো যায় না, এবং যা তৃতীয় পক্ষ, ঔষধ বিক্রেতা যিনি রোগীর সাথে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ নন। কেবলমাত্র এমন ধরনের ব্যক্তি কর্তৃক ঔষধ বিক্রির ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কি সামঞ্জস্যহীনতা। উক্ত প্রবন্ধে ৪৩৪ পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন যে, “আমি পুনরায় বলছি, চিকিৎসককে অবশ্যই কঠিন দন্ডের অধীনে নিষেধ করা উচিৎ তার রোগীদের জন্য আবশ্যকীয় ঔষধটি অন্যকোনো ব্যক্তি কর্তৃক প্রস্তুত করে দিতে। তাকে কঠোর দন্ডের অধীনে বরং নির্দেশ দেওয়া উচিৎ রোগীদের জন্য নিজে ঔষ প্রস্তুত করে দিতে যাতে সে সুফলের জন্য জামিন হতে সক্ষম হয়।"

উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, মহাত্মা হ্যানিম্যান রোগীকে ঔষধের নাম লিখে অ্যালোপ্যাথদের মতো ব্যবস্থাপত্র দেন নি এবং ব্যবস্থাপত্র আমাদেরকেও দিতে নিষেধ করেছেন

আমি এখানে ডা. নীলমনি ঘটকের একজন রোগীর ঘটনা উল্লেখ করছি, যে তার ঔষধের নাম জেনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। "হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা" তৃতীয় খন্ডে ল্যাকেসিস অধ্যায়ে ডা. নীলমনি ঘটক, (বি.এ.) বলেছেন যে, “আমার কোনো একটি রোগী ঔষধের মূল্য দেওয়া অনর্থক মনে করিয়া অতি গোপনে আমার রোগীলিপির বহি হইতে তাহার ঔষধটি 'ল্যাকেসিস-১০০০' লিখিত দেখিয়া বাজার হইতে উহা ক্রয় করিয়া ঘন ঘন ব্যবহার করিয়াছিল এবং ১১ মাত্রা খাইয়া নিতান্ত উনাদের অবস্থায় আমার নিকট আসিয়া সকল কথা প্রকাশ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া প্রতিকার প্রার্থী হয়।" অতএব রোগীর কল্যাণার্থেই তার রোগের নির্দিষ্ট ঔষধটির নাম গোপন রাখতে হয়।

রোগীর কাছে ঔষধ গোপন রাখার আরো কিছু অনিবার্য কারণ আমি নিম্নে উল্লেখ করছি :

১. হোমিওপ্যাথিতে রোগের সাথে ঔষধের লাক্ষণিক সাদৃশ্য এবং রোগীর সংবেদনশীলতার স্তরের সাথে ঔষধের শক্তি ও মাত্রার সূক্ষ্মতার সাদৃশ্য আবশ্যক। এই কারণে নির্বাচিত সদৃশ ঔষধটি উচ্চ শক্তিতে খুব ক্ষুদ্রতম মাত্রায় দিতে হয়। এত অল্প ঔষধ রোগীর পছন্দ না হলে সে ঔষধের নাম জানলে বেশি পরিমাণে দোকান থেকে কিনে খাবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

২. হোমিওপ্যাথিক উচ্চশক্তিকৃত ঔষধ তরলীকরণের ফলে সকল স্বাদ, গন্ধ হারিয়ে ফেলে। রোগীকে এমন ঔষধের জলীয় দ্রাবণ প্রতিবার ঝাকি দিয়ে সেবন করতে হয়। রোগী ঔষধীয় দ্রাবণ প্রস্তুত করতে দেখলে এটি জল ছাড়া কিছু নয় ভেবে তাচ্ছিল্য করে হয়তো ঝাকিই দিবে না। কিন্তু প্রতিমাত্রায় ঝাকি ব্যতীত ঔষধের শক্তির পরিবর্তন হবে না এবং ঝাকিবিহীন যাত্রাটি ফলদায়ক হবে না।

৩. হোমিওপ্যাথিতে রোগের চরিত্রগত লক্ষণের সাথে ঔষধের সাদৃশ্য আবশ্যক। নিদানগত লক্ষণ প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। রোগী যখন তার নিদানগত লক্ষণের সাথে ঔষধের লক্ষণের মিল খুজে পাবে না তখন সে হতাশ হবে এবং ঔষধই সেবন করবে না। রোগের চরিত্রগত লক্ষণগুলো এমন প্রকৃতির হয় যে, রোগের সাথে তার সম্পর্ক যুক্তির মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায় না, যেমন রোগে শীত অবস্থায় প্রবল ঠান্ডা জলের পিপাসা। এর কি যুক্তি আছে?

৪. হোমিওপ্যাথিতে রোগের সাথে ঔষধের লাক্ষণিক সাদৃশ্য ব্যতীত ঔষধের একটি মাত্রাও আরোগ্য সহায়ক হয় না। রোগ বর্তমান থেকে চরিত্রগত লক্ষণ পরিবর্তন হলেই ঔষধ পরিবর্তন করতে হয়। তাই হোমিওপ্যাথিতে একটি ঔষধ লিখে দিয়ে 'চলবে' বলার সুযোগ নেই।

প্রচারে :

ডা. এম আল মামুন 

ডিএইচএমএস (বিএইচবি) ঢাকা।

Next Post Previous Post