৫০ সহস্রতমিক ঔষধ কি প্রতিদিনই প্রয়োগ করা উচিত?

৫০ সহস্রতমিক ঔষধ কি প্রতিদিনই প্রয়োগ করা উচিত? 

প্রায়ই দেখা যায় কেউ কেউ বলে থাকেন– আমি ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, কেউ আবার যৌন ও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি। তবে এটা কি জানেন না যে, হোমিওপ্যাথিতে কোনো রোগের বিশেষজ্ঞ বলে কথা নেই! বিশেষজ্ঞ হতে হলে তো হতে হবে মানবদেহ বিশেষজ্ঞ। 

তবে একথাটি আবার কোনোভাবেই সহজভাবে নেয়ারও উপায় নেই। কেননা, আপনি আমি যদি গভীর অধ্যবসায় দ্বারা হোমিওপ্যাথির বেশ অনেকদূর এগোতে  না পারি, তবে অরণ্যেরোদন করা ছাড়া কপালে কিছুই জুটবেনা। আলো না জ্বালিয়ে অন্ধকারে হাঁটলে যেমন দিকহারা হতে হয়, এখানেও ঠিক তা-ই। 

সুতরাং আমাদের আগে যেটি করতে হবে, তা হলো মানবদেহে ঔষধের প্রভাব, তার প্রয়োগের ধরণ, সময়কাল; জীবনীশক্তির ভূমিকা, মায়াজম বিশ্লেষণ সহ সদৃশ নীতির ভূমিকা– এগুলো নিয়েই বেশী বেশী গবেষণা করা প্রয়োজন। এর বাইরে কেউ কোনো রোগ বিশেষজ্ঞ বলে নিজেকে দাবী করলে, তা হবে ভন্ডামী করা! তাহলে মূল বিষয়ে আসি–

অনেকেই বলে থাকেন বা ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ যাঁর দ্বারা আমাদের দেশে প্রবর্তিত হয়েছে সেই হরিমোহণ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে, উনি যেমন ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ প্রতিদিনই খেয়ে যেতে বলেছেন, সেখানে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। 

আমার চিকিৎসার প্রথমদিকে অনেক চিকিৎসককেই বলতে শুনেছি যে, ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ ২/১ টি পোটেন্সি কাজ করার পর আর কাজ করেনা। তখন ঔষধ পাল্টাতে হয়, তবুও যেনো কোনো ভালো রেজাল্ট  রোগীর মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না, কেউ আরোগ্য হলেও, কেউ আরোগ্য হয় না। এ কথা গুলো যে একদম অবাস্তব, তা-ও কিন্তু নয়। বিষয়টি আমাকেও বেশ ভাবাতো। 

দেখতাম চর্মরোগের ঔষধ দিয়েছি এবং রোগীকে প্রতিদিন খেতেও বলে দিয়েছি, কিন্তু চর্মরোগ তো কেবল বাড়ছেই, ফলে বাধ্য হয়ে ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আবার কোনো ক্ষেত্রে যে কাজ হয়নি, সেটাও আবার বলছিনা। তবে সার্বিক বিবেচনায় এটাই বুঝেছি যে, ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ প্রতিদিনই প্রয়োগ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই– এতে রোগের এলোমেলা অবস্থা বা বিপর্যয়ও দেখা দেয়। আমাকে বিষয় গুলো বেশ ভাবাতো। 

সে যা-ই হোক্, একদিন আমি এক রোগিণীর উভয় ব্রেস্টের মাঝে অনেক গুলো গুটিকা হয়ে জ্বালা যন্ত্রণা শুরু হলে, আমি লক্ষণ সদৃশে একটি ঔষধ প্রতিদিনই ঘ্রাণে প্রয়োগ করি। 

দেখা গেলো তাতে করে লক্ষণ গুলোর কেবল বৃদ্ধিই ঘটতে! আমি অনেকটাই দমে গেলাম, কিন্তু হাল ছাড়লাম না। কি করা যায়? মাথায় কেবল এ বিষয়টিই ঘুরপাক খেতে লাগলো। আমি রোগিণীকে লক্ষ্য করে দেখলাম, ঔষধ তো ঠিকই আছে, কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? সবাই তো বলে যে, ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ প্রতিদিনই খেয়ে যেতে হয়। তাহলে এখানে কিসের প্যাঁচ? বিষয়টি খুব যত্ন করে ভাবলাম এবং অবশেষে স্থির করলাম, যেহেতু আমার ঔষধ প্রয়োগ সঠিকই হয়েছে, তাহলে এখন আমাকে জীবনীশক্তির ঔষধ গ্রহণ করার বিষয়টির দিকেই তাকানো উচিত। আমি তা-ই করলাম। 

জীবনীশক্তির সঙ্গে দার্শনিক ভাবধারায় আলোচনা করলাম। জীবনীশক্তি তখন আমাকে বললো– কেন আপনি কি জানেন না যে, ঔষধের কাছ থেকে সময় ভেদে কখন আমার কতটুকু ঔষধ গ্রহণ প্রয়োজন? 

আপনি কি জানেন না যে, ঔষধ প্রয়োগ করে আমার গ্রহণ ক্ষমতার উপর নির্ভর করে আমার কি অবস্থা দাঁড়ায় সে জন্যে কিছুকাল অপেক্ষা করার প্রয়োজন বা ঔষধ প্রয়োগের পর কাজ শুরু হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয় এবং আমার প্রয়োজনে যখন আবারও লক্ষণ প্রকাশের দ্বারা ঔষধ দিতে বললে, কেবল তখনই ঔষধ দিতে হয়? আমি জীবনীশক্তির এসব প্রশ্ন গুলোর সমাধান বের করলাম। বিষয়টি হলো– ঔষধের রোগ আরোগ্য করার ক্ষমতা নেই, কি চমকে গেলেন? কেন চমকাবো আমরা? 

অর্গানন মেনে চললেই তো সব ঝামেলা খতম। 

এখন কথা হলো– আসলে ঔষধ কেবল জীবনীশক্তিকে সাহায্য করে যাতে জীবনীশক্তি তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায়। 

কোনো দেশ বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে– সে দেশটি যেমন জাতিসংঘের মাধ্যমে অন্য দেশ গুলোর সৈন্য দ্বারা সহায়তা লাভ করে বল বৃদ্ধি করে নিজের দেশের সার্বভৌমত্য রক্ষা করে, ঔষধের বেলায় জীবনীশক্তিও ঠিক তাই করে। লক্ষণ গুলো জীবনীশক্তির ভাষা, অর্থাৎ ঔষধ প্রার্থনা করার ইঙ্গিত এবং এই ঔষধের সাহায্য পেয়ে ষখন জীবনীশক্তি তার হারানো ক্ষমতা ফিরে পায়, তখই কেবল জীবনীশক্তি মানবদেহ থেকে রোগ গুলোকে বিতাড়িত করে দেয়। 

কিন্তু ঔষধের রোগের স্তরে পৌঁছানোর কোনো ক্ষমতাই নেই। এটাই হোমিও দর্শনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত! সুতরাং সময়ের ব্যবধানে জীবনীশক্তি ঔষধের সাহায্য কেমন করে গ্রহণ করবে, তার হিসেব রাখতে হবে প্রতিটি চিকিৎসককেই। 

অবশেষে এ ধারণা নিয়ে যখন আমি দেখলাম আমার রোগিণীর লক্ষণ সবই ঠিক আছে, অথচ প্রতিদিন ঔষধ দিলেই কেবল তা বেড়ে যাচ্ছে, তখন আমি রোগিণীকে ঔষধ ৩ দিন পরপর ঘ্রাণ নিতে বললাম এবং এতেও রোগ বৃদ্ধি পেলে, ৭ দিন পরপর যখন ঔষধ প্রয়োগ করলাম, তখন রোগিণীর লক্ষণ গুলোর উপশম হতে লক্ষ্য করলাম। 

এরপর এ রোগিণীকে ১৫, ২০, ২৫ দিন পরপর ঔষধ কেবল ঘ্রাণে প্রয়োগ করে আল্লাহ্‌র রহমতে সুস্থ করতে পেরেছিলাম। আর এখানে যদি আমি ঔষধ ঘ্রাণে না দিয়ে রোগীকে সেবন করতে দিতাম, তাহলে কাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করে রোগীর সামর্থ্য বুঝে যতো গুলো কাপই পরিবর্তন করে ঔষধ দিতাম না কেন, ঔষধ ঠিকই কাজ করতো। এ আত্মবিশ্বাসটুকুও হোমিওর আরেকটি দর্শন এবং প্রত্যেক চিকিৎসকের তা অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করতে হবে। কে বলে হোমিওপ্যাথিক পানিপড়া, কে বলে হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান সম্মত নয়। যদি এটা হয়, তবে পদার্থ বিজ্ঞানের কথা মুছে ফেলতে হয়? কেননা, যেখানে পদার্থ বিজ্ঞান বলছে যে, যেকোনো পদার্থই অবিনশ্বর, সে কেবল তার রূপ পরিবর্তন করে, কখনোই অস্তিত্ব হারায় না। 

তাহলে হোমিওপ্যাথি কেন পানিপড়া হবে? আপনি আমি হোমিও ঔষধকে যতোই সূক্ষ্মস্তরে নিয়ে যাই না কেন, মানবদেহে বা রুগ্নদেহে কাজ করবেনা এমন দৃষ্টান্ত কেউই দেখাতে পারবেন না! তাহলে এখন বুঝে দেখুন আমাদের আসলে কি কি বিষয় নিয়ে গবেষণা করে হোমিওপ্যাথিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। 

সুতরাং আমি বলবো এবং আপনারও নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে দেখবেন যে, ৫০ সহস্রতমিক ঔষধ প্রতিদিন প্রয়োগ না করে, পরপর ২ দিন ঔষধ প্রয়োগ করে ৪/৫ দিন অপেক্ষা করে করে, প্রয়োজনে পুনঃ প্রয়োগ, এ পদ্ধতিতে অগ্রসর হলে রোগীর মঙ্গলই হওয়ার কথা। 

তবে তরুণ রোগে ঔষধ ঘন ঘন প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। আরও একটি কথা ঔষধ যখনই জীবনীশক্তিকে সাহায্য করতে পেরেছে বলে বিবেচিত হবে, তখনই অতি অবশ্যই ঔষধ প্রয়োগ বন্ধ করে দিয়ে রোগীকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে পুনঃ প্রয়োগ, নইলে নয়। তা নাহলে আমার ধারণা সাফল্য হয়তো পথেই হোচট খাবে। ধন্যবাদ।


লেখক :

ডাঃ এ.বি.এম.শহীদুল্লাহ্ 

ডিএইচএমএস(বিএইচবি-ঢাকা)

ক্লাসিক্যাল হোমিওপ্যাথ

Next Post Previous Post