ডা. কেন্ট কেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাতে এলেন
১৮৪৯ সালের ৩১ মার্চ জেমস টাইলার কেন্ট নিউইয়র্কের উডহাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭০ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ার জন্য নিউইয়র্ক এর ব্যালেভু মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন।
সেখান থেকে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ডক্টর অফ মেডিসিন বা এমডি ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি সিনসিনাটি একলেকটিক মেডিকেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ঐ সময়ে অ্যালোপ্যাথি এবং একলেকটিক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান সমান ছিল। একলেকটিক ইনস্টিটিউট থেকে পাশ করে কেন্ট সেন্ট লুইস শহরে একলেকটিক চিকিৎসক হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু করেন। অল্প সময়ে কেন্ট লুইসের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের শুরুতেই ২৬ বৎসর বয়সে কেন্ট একজন আমেরিকান মহিলাকে বিবাহ করেন। দুর্ভাগ্য বশত বিবাহের অল্প কিছুদিন পরে তার সে স্ত্রী মারা যান। দীর্ঘদিন বিপত্নীক থাকার পর ১৮৯৬ সালে ৪৭ বছর বয়সে তিনি আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল ক্ল্যারা লুইস। তিনি ও এম ডি চিকিৎসক ছিলেন । একলেকটিক চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কেন্ট এর দ্বিতীয় স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। কেন্ট নিজে এবং একলেকটিক অভিজ্ঞ চিকিৎসকগন সহ চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে পরে বিশিষ্ট এলোপ্যাথিক চিকিৎসকদেরকে ও ডাকা হয়। সকালের চেষ্টা ব্যর্থকরে দিয়ে তার অবস্থার দিন দিন অবনতি ঘটতে থাকে। নিদারুণ দুর্বলতা, রক্তাল্পতা, দীর্ঘদিনের অনিদ্রায় তিনি কাহিল হয়ে পড়েন। কেন্টের স্ত্রী এর আগে হোমিওপ্যাথির বিস্ময়কর চিকিৎসার কথা শুনেছিলেন। কেন্টের স্ত্রী শহরের প্রবীণ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ ফেলানের সাথে তার চিকিৎসা বিষয়ে যোগাযোগের জন্য স্বামী কেন্টকে অনুরোধ করেন।
হোমিওপ্যাথির সূক্ষ্মমাত্রার চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতি কেন্ট বরাবরই বিরুদ্ধাচরণ করতেন। অবশেষে তার স্ত্রীর বার বার আকুতির পর নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেওমডাঃ ফেলানের সাথে যোগাযোগ করে তার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ফেলানকে তার বাড়িতে আসার অনুরোধ করেন।
ডাঃ ফেলান কেন্টের বাড়িতে এসে রোগিণীর মানসিক সমস্যা, নিদ্রা, স্বপ্ন, খাদ্য পানীয় রুচি অরুচি, ঠান্ডা গরমের প্রভাব, ও সার্বদৈহিক লক্ষণ সংগ্রহ করে ঔষধের ব্যবস্হা করেন। একগ্লাস পানিতে কয়েকটি বটিকা দিয়ে রোগিণী ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত দুই ঘন্টা পর পর এক চামচ করে সেবনের পরামর্শ দেন। কেন্ট পাশ থেকে নিতান্ত অবঞ্জাভরে অদ্ভুত রোগীলিপি তৈরি ও অবান্তর প্রশ্ন করতে দেখে বিরক্ত বোধ করছিলেন। ওষুধ খেয়ে রোগিণী ঘুমিয়ে পড়বে বলাতে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছিলেন।
ডাঃ ফেলান চলে যাওয়ার পর কেন্ট তার স্ত্রীকে এক চামচ ওষুধ সেবন করিয়ে পাশের ঘরে চলে যান। সেখান থেকে দুই ঘন্টার ও পর এসে দেখেন রোগিণী ঘুমিয়ে আছে। কেন্ট আশ্চর্য হলেন, যেখানে স্হুুলমাত্রার ওষুধে ঘুম আসে নাই সেখানে সামান্য পানি ওষুধ প্রয়োগে তা কী করে সম্ভব হলো?
কেন্ট হোমিওপ্যাথিক ঔষধের বিস্ময়কর ক্রিয়া দেখে বিমোহিত হলেন। স্ত্রীর আরোগ্য ক্রিয়া প্রত্যক্খ করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানে কেন্টের মত উজ্জ্বল জ্যোতিস্কের আবির্ভাবের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেল। কেন্ট কালবিলম্ব না করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ ফেলানের নিকট গিয়ে তার আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এদিকে ডাঃ ফেলানের চিকিৎসায় কেন্টের স্ত্রীর পরদিন থেকেই অপ্রত্যাশিত উন্নতির মাধ্যমে একলেকটিক ও এলোপ্যাথি চিকিৎসাকে অসার প্রমাণিত করেছিলেন।
ইতিমধ্যে কেন্ট তার একলেকটিক চিকিৎসা ত্যাগ করে হোমিওপ্যাথি বিষয়ে রাতদিন পড়তে থাকেন। ১৮৭৯ সালে একেই সঙ্গে আমেরিকান মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকের পদ ও একলেকটিক চিকিৎসকদের মেডিকেল এসোসিয়েশন থেকেও পদত্যাগ করেন। হোমিওপ্যাথির অবঞ্জাকারী ও ঘোর বিরোধী ডাঃ জেমস্ টাইলার কেন্ট রূপান্তরিত হলেন হোমিওপ্যাথির ধারক ও বাহক। সমকালীন বিশ্বে তারমত বিচক্ষণ এবং প্রঞ্জাসম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক খুব কমই ছিলেন।
১৮৮১ সালে কেন্ট লুইসের মিসৌরি হোমিওপ্যাথি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকও চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করেন। ১৮৮২ সালে সার্জারি বিভাগের অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৩ সালে ঐ কলেজের মেটেরিযা মেডিকার অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেন। মেটেরিযা মেডিকা ছিল কেন্টের প্রিয় সাবজেক্ট। কেন্ট আমরণ বিশুদ্ধ হোমিওপ্যাথি চর্চা করে গেছেন। কেন্ট নিঃসন্দেহে সমকালীন হোমিওপ্যাথি জগতের একজন নক্ষত্র ছিলেন। অবশেষে ১৯১৬ সালে ৬ জুন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক সমাজকে শোকের সাগরে নিমজ্জিত করে চিরশান্তির আশায় পরপারে গমন করেন।
ক্ষণজন্মা এই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহাপুরুষকে আমেরিকার মন্টানার স্টিভেন্সভিলেরসা নিসাইড সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।
লেখক
ডা. এম মোহসীন চৌধুরী
হোমিওপ্যাথি মেডিসিন কনসালটেন্ট
সোনাগাজী, ফেনী।
১৫.১০.২০২২ ইং