চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে হোমিও ডাক্তারদের প্রতি কিছু উপদেশ

সম্মানিত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গনের জন্য আমার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু উপদেশ।

আমি এতোই অথর্ব, অযোগ্য, অদক্ষ, অপরিপক্ক ও অদুরদর্শী যে আমি কোন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গনকে কোন ধরনের উপদেশ দেয়ার ক্ষমতা রাখি না।

তারপরও বয়স হয়ে গিয়েছে, শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, আগের মতো লিখতে ও পারছি না, তাই সামান্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের ব্যার্থতা সমুহের আলোকে আপনাদের উদ্বেশ্যে কিছু কথা বলছি।

প্রথমত কথা হলো- সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র, ছাত্রী গনকে চিকিৎসা বিষয়ক মৌলিক কিছু পাঠ অবশ্যই নিতে হয়।

যেমন এ্যনাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, গাইনোকোলজি, মিডওয়াইফারি, জুরিসপ্রুডেন্স, সার্জারি এবং অবশ্যই মেডিসিন ইত্যাদি।

কিন্তু পাস করে প্র্যাকটিস জীবনে সার্জন, প্যাথলজিষ্ট বা গাইনোকলজিস্ট না হলে, (কারন গাইনিতে ও সার্জারি করতে হয়) মেডিসিন ব্যাতীত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তেমন বেশি আর কোন প্রয়োজন পড়ে না।

তবে মেডিসিনের প্রয়োজন আপনার চিকিৎসা জীবনে সব সময় সব প্যাথিতেই প্রয়োজন হবেই।

একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে আপনি DHMS, BHMS বা MD যেটাই সম্পন্ন করে থাকুন না কেন, হোমিওপ্যাথি মেডিসিনের বা মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞান আপনার চিকিৎসা জীবনের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন।

এখানে এ্যলোপ্যাথি এবং হোমিওপ্যাথির মধ্যে মৌলিক কিছু প্রার্থক্য আছে :

হোমিওপ্যাথি তার জম্ম লগ্ন হতেই ফান্ডামেন্টাল সাইন্স, কিন্তু এ্যলোপ্যাথি হলো এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্স।

এক্সপেরিমেন্টাল সাইন্স হবার কারনে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে ঔষধ ক্ষতিকর বিবেচিত হয়ে বাদ পড়ে যাচ্ছে, আবার সে স্থান নতুন নতুন ঔষধ দখল করে নিচ্ছে।

তাই এ্যলোপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি সমুহের প্রচুর সংখ্যক মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নিয়োগ থাকেন, চিকিৎসক গনকে নতুন ঔষধ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করার জন্য।

কিন্তু হোমিওপ্যাথির বেলায় এমন কোন ব্যাবস্থা নেই।

কোন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ এসে আপনাকে শিখিয়ে দিয়ে যাবেন না।

আপনার জ্ঞান আপনাকেই অর্জন করতে হবে :

আমি কলেজে শিক্ষকতা কালীন প্রায় সময় উপদেশ মুলক কিছু কথা বলতাম, তার একটি ছিলো আল্ কুরআনুল কারীমের হাফিজ হওয়া সহজ, কিন্তু হাফিজ থাকা অনেক অনেক বেশি কঠিন।

ঠিক তেমনি হোমিওপ্যাথি মেটেরিয়া মেডিকা মুখস্থ করা সহজ, কিন্তু হোমিওপ্যাথি মেটেরিয়া মেডিকার লক্ষন সমূহ মনে রাখা ও একটির সঙ্গে অপরটির প্রার্থক্য বিশ্লেষন করা শুধুমাত্র কঠিন ই নয়, বরং প্রায় অসম্ভব,যদি নিয়মিত পড়াশোনা না করা হয়।

কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রধানত দুটি সমস্যা দেখা দেয়, একটি হলো ছাত্র জীবনে প্রচুর পড়াশোনা কারি ছাত্ররাও প্র্যাকটিস জীবনে এসে তেমন পড়াশোনা করে না।

অনেকে বিয়ে করে, বিয়ে বসে কমবেশি সংসার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ার কারণে আগের মতো পড়াশোনা করার সময় পান না।

অনেকে আবার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবার কারনে পূর্বের মতো পড়াশোনা করতে পারেন না।

দ্বিতীয়ত- অনেক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসক মনে করেন, অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, হাজার হাজার রোগী আরোগ্য করেছি, এখন আর আগের মতো পড়াশোনা করার প্রয়োজন নেই।

আবার অনেকে একটু বয়স হয়ে গেলে বয়স্ক জনিত কারণে, সংসারের বিভিন্ন ঝামেলায় আর পড়তে পারেন না, ইচ্ছাও থাকে না।

এ সকল কারন গুলো কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনাকে অনেক পিছিয়ে দেবে।

আপনি একসময় মেটেরিয়া মেডিকার পন্ডিত ছিলেন, এখনো মনে করেন আপনি আগের মতোই পন্ডিত আছেন :

কিন্তু বহুদিন মেটেরিয়া মেডিকা খুলে দেখা হয় নি, না দুঃখিত আপনি আর মেটেরিয়া মেডিকার পন্ডিত নেই।

আপনি অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন, আপনি যে মেটেরিয়া মেডিকার অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন, তা আপনি নিজেও জানেন না।

আনকমন ঔষধ তো দুরের কথা, অনেক কমন ঔষধ সমুহ যা আপনি নিত্য ব্যাবহার করেন, তার প্রধান দু-তিন টি লক্ষন ব্যাতীত অন্যান্য লক্ষন সমূহ ও আপনি ভুলে গিয়েছেন।

দীর্ঘদিন বই না পড়ার কারনে আপনি এখন অতি প্রয়োজনীয় পলিক্রেষ্ট ঔষধ সমূহের মাত্র প্রধান কয়েকটি লক্ষন ই মনে রাখতে পেরেছেন।

যেমন সালফারের অসংখ্য লক্ষন সমূহের মধ্যে আপনার এখন হাত, পা, মাথার তালুতে জ্বালা, নোংরা চলাফেরা, চুলকানোর পর জ্বালা এ কয়েকটি মনে আছে।

রাসটক্সের লক্ষনের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে রোগ,অস্থিরতা, প্রথম নড়াচড়ায় বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নড়াচড়ায় উপশম, এত্তো টুকুই আপনার মনে আছে,বাকি লক্ষন সমূহ হজম হয়ে গিয়েছে।

আর্সেনিক এর বেলায় অস্থিরতা, মৃত্যু ভয়, ছটফটানি মন আছে, বাকিগুলো আর মনে নেই।

অনেক ঔষধের মানসিক লক্ষন, এক ঔষধের সঙ্গে অন্য ঔষধের আভ্যন্তরীন সম্পর্ক আপনার এখন আর মনে নেই।

আপনার প্রচুর রোগী, আপনি অতি ব্যাস্ত চিকিৎসক,তাই হাতের নিকট শর্টকাট ঔষধ নির্বাচন এর জন্য থেরাপিউটিক টাইপের বই রেখেছেন।

যেমন সায়েটিকায় প্রথমে ব্রায়োনিয়া ২০০,ব্রায়োনিয়ায় উপকার না হলে কলোসিন্থ ২০০, কলোসিন্থে উপকার না হলে ফাইটোলক্বা ২০০ দেবেন।

এখন কিসের ভিত্তিতে ব্রায়োনিয়া ২০০,আবার ব্রায়োনিয়া ২০০ এর সম্ভাব্য ক্রিয়া কতোদিন, আবার ব্রায়োনিয়া ২০০ দ্ধারা উপকার না হলে কিসের ভিত্তিতে কলোসিন্থ বা ফাইটোলক্কা, তার কোন ব্যাখ্যা এ সকল বইতে নেই।

অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,গ্ৰাম ও শহরের হাজার হাজার হোমিওপ্যাথি নামধারী,ডিগ্ৰিধারী চিকিৎসক গন ও এ সকল অহোমিওপ্যাথি বই অনুসরণ করে রোগী চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। হোমিওপ্যাথিতে কোন রোগের জন্য কোন স্পেসেফিক ঔষধ নেই,সার্বিক লক্ষণ নিয়ে ঔষধ দিতে হয়, এবং ঔষধেকে কাজ করার মতো সময়ও দিতে হয়।

তরুণ রোগে অতি প্রয়োজনে হয়তো ঘনঘন ঔষধ দিতে হয়, কিন্তু ক্রনিক কেস এ কখনোই ঘনঘন ঔষধ প্রয়োগ করা যাবে না।

সুনির্বাচিত গভীর ক্রিয়াশীল ঔষধ কে তার কাজ করার মতো সময় দিতে হবে।

আপনি একসময় বিভিন্ন ধরনের অনেক হোমিওপ্যাথি বই কিনে আলমারি পুরো করে ফেলেছিলেন :

কিন্তু বহুদিন এ আলমারি খোলা হয় নি, দয়া করে বন্ধ আলমারি আবার খুলুন, আবার পড়ুন, এ খোলা আলমারি, এ নতুন করে আবার পড়াশোনা শুরু করা, হয়তো নতুন করে আপনার জ্ঞানের দরজা খুলে দেবে।

সম্ভব হলে নামকরা লেখক গানের, আমাদের অথর গনের নতুন বই কিনুন পড়ুন :

তবে আগে যেগুলো কিনেছিলেন, যেগুলো আপনার বেশি পরিচিত, সেগুলো পুনরায় আবার পড়ুন।

যদিও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞানে মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞান অপরিহার্য, তবুও শুধুমাত্র মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞান দিয়েই হোমিওপ্যাথি চলবে না।

আপনাকে ভালো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হতে হলে মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞানের পাশাপাশি কমপক্ষে প্যাথলজি ও প্র্যাকটিস অফ মেডিসিন এর উপর ভালো জ্ঞান থাকতে হবে।

তার জন্য আপনি প্র্যাকটিস অফ মেডিসিন এর ভালো জ্ঞান অর্জনের জন্য এ্যলোপ্যাথি মতে লিখিত বিশ্বের সর্ব শ্রেষ্ঠ বই DAVIDSON'S PRINCIPLES AND PRACTICE OF MEDICINE নামক বই এর সহায়তা নিতে পারেন, তবে চিকিৎসা করবেন কিন্তু হোমিওপ্যাথি নিয়মে।

আমরা এ্যলোপ্যাথি চিকিৎসা বিজ্ঞান কে যতোই গালমন্দ করি না কেন, তাদের গবেষনার তুলনায় আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে আছি।

DAVIDISON'S PRINCIPLES AND PRACTICE OF MEDICINE এর এক এডিশনের সাথে পরবর্তী এডিশনের অনেক অনেক প্রার্থক্য।

অনেক কিছু বাদ পড়ে যায় অনেক নতুন তথ্য যুক্ত হয়, যা সত্যি অবাক করার মতো।

এ ছাড়াও বাজারে প্যাথলজির উপর বিভিন্ন ধরনের ভালো বই পাওয়া যায়, কিন্তু সমস্যা হলো তার প্রায় সবগুলোই ইংরেজি ভাষায় লিখিত, ইংরেজিতে দক্ষতা এবং মেডিকেল টার্ম জানা না থাকলে, বুঝতে কষ্ট হবে।

আপনি জাল নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে শুধু বড় মাছ গুলো দিয়ে খলুই ভরবেন, তাহলে ভরলে খলুই কখনোই পুরবে না।

খলুই তে খালি জায়গা থেকেই যাবে,সে খালি জায়গা পুরন করতে হলে আপনাকে ছোট ছোট মাছ খলুইতে নিতেই হবে।

তাই- আমাদের মেটেরিয়া মেডিকার ছোট ছোট ঔষধ কে গুরুত্ব হীন মনে করবেন না।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ছোট ঔষধ সমুহ চমৎকার ফল দেয়, যা আপনি চিন্তা ও করতে পারবেন না :

আপনি আগে অনেক অনেক পড়েছেন, আপনার নিকট যে সমস্ত লক্ষন সমূহ গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল, আপনি তা বইতে দাগ দিয়ে রেখেছিলেন।

বইটি আপনার,দাগ দেয়াও আপনার হাতের,আজ অনেক দিন পর বইটি খুলে দেখুন,আপনি চমকে উঠবেন,এ কি আমি  এ লক্ষন টি পড়েছি এবং দাগ ও আমি দিয়েছি, কিন্তু এ লক্ষনটি তো একদম মনে ছিল না,ওয়াও সম্পুর্ন ভুলে গিয়েছিলাম।

একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা অবশ্যই মনে রাখবেন,আর সেটা হলো শুধুমাত্র এ্যলোপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতেই রোগ চাপা দেয়া হয় না, হোমিওপ্যাথি ঔষধ দ্ধারা ও প্রচুর রোগ চাপা দেয়া যায়, এবং অতি দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, প্রতিনিয়ত হোমিওপ্যাথি ঔষধের নামে, তথাকথিত হোমিওপ্যাথি ঔষধ দ্ধারা প্রচুর রোগীর রোগ চাপা দেয়া হচ্ছে।

যার অন্যতম প্রধান কারণ চিকিৎসক গনের অর্গানন, হোমিওপ্যাথির নিয়ম নীতি ও বিশেষ করে মেটেরিয়া মেডিকার জ্ঞানের স্বল্পতা।

তাই সকল বয়সের, সকল শ্রেনীর সম্মানিত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গনের প্রতি আন্তরিক অনুরোধ, হোমিওপ্যাথির কল্যানে, আপনার কল্যানে, আপনার রোগী গনের উপকারার্থে আপনি নতুন করে আবার পড়াশোনা করতে থাকুন।

শেখার কোন শেষ নেই, প্রয়োজনে সিনিয়র দের নিকট হতে শিখুন, পরামর্শ নিন :

আবার আপনি সিনিয়র বলেই আপনি সবজান্তা, এমনটি না ও হতে পারে, জুনিয়র দের নিকট ও অনেক কিছু শেখার থাকতে পারে।

তাই দয়া করে সিনিয়র, জুনিয়র সকলে মিলে সমম্বয় করুন, সমম্বয় করুন নিজেদের অর্জিত জ্ঞান পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়ের, সমম্বয় করুন নিজেদের সাফল্য, ব্যার্থতা, সমম্বয় করুন নিজেদের মধ্যে অন্তত হোমিওপ্যাথির স্বার্থে।

সবার প্রতি সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম।

ডাঃ মহিব্বুর বহমান

সিনিয়র হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, 

নোয়াখালী। 

২-৭-২০২১

Next Post Previous Post