মানসিক রোগ কিভাবে সৃষ্টি হয় : গল্প নয় সত্যি
দেখতে দেখতে মেহেজাবিনের বয়স ১২ বছর হয়ে গেল। একদিন বান্ধবীদের সাথে গোল্লাছুট খেলার সময় হঠাৎ করে মেহজাবিন তার শরীর থেকে কিছু একটা বেরিয়ে যাচ্ছে অনুভব করলেন। দৌড়ে বাসায় গিয়ে মাকে অভিযোগ করলে। মা তার টাউজার খুলে কিছু রক্ত দেখতে ফেলেন। মা সাথে সাথে মেয়েকে গোসল করালেন নতুন কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং কাপড় চোপড় পরিবর্তন করে দিলেন। আত্মীয়স্বজনদের খবর দিলেন, দুধ কলা খাবালেন এবং ভবিষ্যৎ চলার একটা গাইডলাইন তৈরি করলেন।
মায়ের এসমস্ত কার্যাবলী দেখে মেহজাবিন বিস্মিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন না কেন মা এগুলো করছেন। মেহজাবিনকে ঘর থেকে বের হতে দিলেন না। খেলাধুলা বন্ধ করে দিলেন। জিন্সের প্যান্ট এর পরিবর্তে সালোয়ার কামিজ ও মাথায় ওড়না পরিয়ে দিলেন। দর্জির কাছে নিয়ে বোরকার মাপ দিলেন। মা বাড়ির ছেলেদের সাথে এবং খালাতো মামাতো ভাইয়ের সাথে দেখা করা কথা বলা মিলামিশা থেকে বিরত থাকার কড়া নির্দেশ দিলেন।
মায়ের এসমস্ত হুকুমজারিতে ভিতরে ভিতরে মেহেজাবিন অস্থির হয়ে উঠলেন। ছেলে মেয়েদের সাথে মেহেজাবিনের ছোটাছুটি দৌড়াদৌড়ি বন্ধ হয়ে গেল। জিন্সের প্যান্ট আর গেঞ্জির পরিবর্তে সেলোয়ার-কামিজ ডোলাডালা জামা মাথায় হিজাব উঠলো। এগুলো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিধায় মেহেজাবিনকে তিলে তিলে কষ্ট দিতে শুরু করে। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে মা সাথে করে স্কুলে দিয়ে আসে এবং ছুটির পর সাথে করে নিয়ে যায়। আগে রাতের পড়া শেষ করে মেহেজাবিন নিজ দায়িত্বে ঘুমিয়ে পড়তো এখন পড়া শেষ করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত মা পাহারা বসে থাকে। মায়ের এসমস্ত কার্যাবলী দেখে মেহেজাবিন স্তম্ভিত হয়ে যায়। মেহেজেবিন বলিতে ও পারেনা সহিতে ও পারেনা। কি দোষ পেয়ে মা এরকম খড়গহস্ত হয়েছেন তা সে ভেবে পাচ্ছেনা! রাতে মায়ের সাথে এক বিছানায় শুইলে ও মেহেজাবিনের এসব ভাবতে ভাবতে ঘুম আসে না। শেষ রাতের দিকে ঘুম আসার কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে না মেহেজাবিন। অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। ধীরে ধীরে স্কুলে যাওয়ার প্রতি আগ্রহ তার কমে যায়। ভোরে ঘুম থেকে উঠার জন্য মায়ের চাপাচাপিতে মেহেজাবিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন।
একটা জাতি যেমন স্বাধীনতা লাভের জন্য ভিতরে ভিতরে ব্যকুল হয়ে উঠে কিন্তু স্বৈরশাসকের ভয়ে তা প্রকাশ করতে সাহস পায়না ঠিক তেমনি মেহেজাবিন তার মাকে স্বৈরশাসকের মতই মনে করেন। দিনের পর দিন যে মা বিনাকারণে তার জীবনের সকল স্বাধীনসত্তা গুলো থেকে তাকে বঞ্চিত করছেন সে মায়ের নিকট মনের সঞ্চিত কষ্ট যাতনা গুলি শেয়ার করার পরিবর্তে চেপে রাখা উত্তম মনে করেন মেহেজাবিন। শুরু হয়ে যায় মেহেজাবিনের মনোজগতে অস্থিরতা।
মায়ের অন্যায় কার্যকলাপে ধীরে ধীরে মায়ের প্রতি ঘৃণা বোধ জাগ্রত হতে থাকে। মনোঅস্হিরতার পাশাপাশি ইদানীং শরীরটা ও ভালো যাচ্ছিলোনা। কিছু দিন যাবত মাসিকের অনিয়মিত হচ্ছে। পিরিয়ড শুরুর পূর্বে প্রচন্ড ব্যথা ও প্রচুর স্রাবের মাধ্যমে যেন মেহেজাবিনের মনের লুকায়িত যন্ত্রণা ও চেপে রাখা অশ্রুপাতের রূপান্তরিত রূপ।
মাসিক হলো একটা বিশেষ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। ১০ বছর বয়স থেকে ৪৫ বছর বয়স্ক মহিলাদের দেহে নিয়মিত ঘটে থাকে। এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টোরেন নামক স্ত্রী হরমোন এই প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। নারীদেহে মাসিক চক্র সম্পন্ন হয় বিধায় নারীরা সন্তান ধারণ করে থাকেন। এ যেন সৃষ্টি এবং স্রষ্টার অবধারিত বিধান।
দেখতে দেখতে মেহেজাবিন এর বয়স ১৮ বছর হয়ে গেল। মায়ের কঠোর অনুশাসন এর মধ্যে স্কুল জীবন পার করে কলেজে পদার্পণ করলেন। কলেজ পড়ুয়া মেহেজাবিন এর সখ্যতা গড়ে উঠে একেই ক্লাসের মেধাবী এক শিক্ষার্থীর সাথে। মন দেয়া নেয়া থেকে শুরু করে বই-পুস্তক বিনিময় পর্যন্ত চলতে থাকে।
নোট খাতা দেওয়ার জন্য ছেলেটা একদিন মেহেজাবিনদের বাড়ি এলে তার মা এটাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। শুরু হয় তোলপাড়। মেহেজাবিনের কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
তার ওপর নজরদারি বেড়ে গেল। বিদেশ থেকে ফোন করে মেহেজাবিনের বাবাকে নিয়ে এলেন। মেহেজাবিনের মায়ের পরামর্শে মেয়ের সন্মতি ছাড়াই এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ির নিকট বিয়ের বিষয় চুড়ান্ত করে ফেললেন। যথাসময় বিবাহ কার্য সম্পাদনের পর থেকেই মেহজাবিনের জীবনে ধীরে ধীরে নেমে এলো কালো রাত্রির অধ্যায়।
বিবাহের পর বাসররাতে ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে পাত্রকে অনেক রাত করে ফিরতে হল।ফুল দিয়ে সাজানো গুছানো বাসরে মেহেজাবিন একা একা ভিড় ভিড় করছে। বাসর রাত বলে যে একটা উৎসাহ আনন্দ আবেগ তার কিছুই মেহজাবিন এর মধ্যে লক্ষ করা গেল না।
সে যেন আনমনে কি যেন ভাবছে। বিশাদ , অবসাদ, হতাশা, উদাসিনতা নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ছে মেহেজাবিন তা বলতে পারে না। গভীর রাতে ব্যবসায়ীক কাজ সেরে স্বামী বাসর ঘরে ঢুকে মেহেজাবিনকে না জাগিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়েন।
ব্যবসায়িক ব্যস্ততায় আবার ও ভোরে মেহেজাবিনকে না জাগিয়ে স্বামী বেরিয়ে পড়েন। এসব বিষয়গুলি মেহেজাবিনকে খুব একটা নাড়া দিচ্ছে না। একটু পরে শাশুড়ি ননদি মেহেজাবিনের ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি উঠে ঘর ঝাড়ু দিতে এবং থালা-বাসন প্লেট পরিষ্কারের নির্দেশ দেন। এগুলির শেষ হলে শাশুরি সবার জন্য রুটি প্রস্তুতের পরামর্শ দেয় । কোন প্রকার ওজর-আপত্তি না করে মেহেজাবিন সব করে যাচ্ছেন।
দুপুরের খাবার শেষের পর শাশুরি অনেকগুলা কাজের পরামর্শ দিলেন মেহজাবিনকে। কাজগুলা করতে করতে এক পর্যায়ে মেহেজাবিন মাথা ঘুরে পড়ে যান, চোয়াল আটকে যায় কোন সাড়া শব্দ হচ্ছিলো না তার। শুরু হলো মেহেজাবিনের জীবনের নতুন অধ্যায়।
খবর দেওয়া হল মেহেজাবিনদের বাড়িতে। তাড়াহুড়া করে মা-বাবা দেখতে এলেন। ততক্ষণে মেহেজাবিনের চোয়াল খুলে গেল। মেহেজাবিনের শাশুড়ি অভিযোগ শুরু করলেন, আপনার অসুস্থ মেয়েকে আমার ঘরে তুলে দিয়ে আর ছেলের ভবিষ্যৎ কে শেষ করে দিলেন।একটার পর একটা বিরম্বনা মেহেজিবিনের জীবনে যেন লেগেই আছে।
মেহেজাবিনের কাহিনী তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো কিভাবে মানসিক রোগ সৃষ্টি হয় তা আপনাদেরকে অবহিত করার জন্য। প্রশ্ন আসতে পারে, এরকম ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রে ঘটলেও সবাইতো মানসিকভাবে আক্রান্ত হন না। মূলত যাদের পূর্বপুরুষগণের চাপা পড়া যৌন রোগের ইতিহাস ও বংশগত মানসিক রোগের ইতিহাস পাওয়া যায় তারাই আক্রান্ত হন বেশি। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ব্রেইন ইমাজিং এবং টমোগ্রাফি পরীক্ষা করে রাসায়নিক পরিবর্তন পাওয়া যায়। ইদানিংকালে এলোপ্যাথি চিকিৎসকগণ জিন থেরাপি ও বিবেচনা করছেন।
মেহেজাবিনের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় :
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা চাওয়া পাওয়ার অসঙ্গতি, নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন এ বাধা, ও মানবিক মূল্যবোধের অবমূল্যায়নের কারণে মেহেজাবিনের জীবনে মানবিক বিপর্যয় তথা মানসিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। এই সমস্যা ঔষধ নির্ভরতার চাইতে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কে উদারীকরণ এর মাধ্যমে সমাধান করা অনেক সহজ।
সমাপ্ত
ধন্যবাদান্তে :
হোমিওপ্যাথি মেডিসিন কনসালটেন্ট
সোনাগাজী, ফেনী।