প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় খুঁজে না পাওয়া রোগ : হিস্টিরিয়া

 নিলুফার জাহান (২৪) ছদ্মনাম। চার মাস পূর্বে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আশরাফুল ইসলামকে (ছদ্মনাম) । বিয়ের ৪  মাস পর চাকুরী নিয়ে  সৌদি আরব পাড়ি  জমালেন আশরাফুল ইসলাম।অর্থনৈতিক কারণে  সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবশেষে  অনেক আকাঙ্খার স্ত্রীকে ঘরে রেখে সৌদি আরব পাড়ি জমালেন আশরাফুল ইসলাম।  সদ্য পাওয়া ভালোবাসার প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে সৌদি আরব যাওয়া   আশরাফুলের  নিকট অনেক কষ্টের হলেও অর্থনৈতিক কারণে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন । 

এদিকে  সদ্য  বিবাহিতা  নিলুফার বাড়িতে একা একা সময় যেন  কাটতে চায় না। অবশেষে সৌদি আরব থেকে আশরাফুলের পাঠানো মোবাইলে ফেসবুক খোলে ইউটিউব দেখে নিলুফার সময় কাটছিল। কিন্তু এই সুখ বেশিদিন সইল না। শাশুড়ি এবং ননদি  নিলুফার মোবাইল চালানোটাকে  ভালো চোখে দেখছিল না। 

ননদ ও শাশুড়ি মোবাইল চালনোর উপর নিষেধাজ্ঞা  আরোপ করে তা বন্ধ করতে না পারে  অবশেষে আশরাফুলের নিকট বিচার দেওয়া শুরু করলো।  ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথায় আশরাফুল অবশেষে স্ত্রীর উপর চাপ শুরু করলেন। স্বামীর বাড়াবাড়িতে  নিরুপায় নিলুফার একসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। এদিকে ভালোবেসে বিয়ে করার কারণে বাবার বাড়ির সাথে তেমন যোগাযোগ নাই নিলুফার ।  শাশুড়ি ননদ ও স্বামীর  চাপাচাপি তে চোখে অন্ধকার দেখছিলেন নিলুফার । রাত্রে  ঘুম আসেনা, ঘুমাতে গেলে  হাত-পা ঝিমঝিম করতে থাকে। মাঝে মাঝে মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ছোয়াল খেচে যায়, কথা বলতে পারেনা। ইতিমধ্যে শাশুড়ি বৌমা কে ডাক্তার দেখিয়েছেন।পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোন রোগ না পেয়ে ডাক্তার স্বামীকে বাড়ি আসতে  বলেছেন। এরপর তাবিজ কবজ করে ও কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। ইতিমধ্যে নিলুফার সমস্যা বাড়তে লাগলো। 

কখনো চোয়াল খিচে যাচ্ছে, কখনো বিনা কারণে হাসছে, কখনো বিনা কারণে কাঁদছে, কখনো কাঁদতে কাঁদতে হেসে দিচ্ছে, আবার কখনো  হাসতে হাসতে কেঁদে দিচ্ছে!  মাঝে মাঝে  বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে । গলার মাঝে চাকার  মত কি একটা বসে থাকে, পানাহার করার সময় গলার চাকাটা চলে যায়।  এসমস্ততথ্যগুলি আমার সামনে উপস্থাপন করতে  করতে নিলুফার দাঁত মুখ খিচে গেল, চোয়াল শক্ত ভাবে আটকে গেল । রোগিণীর  কাহিনী শুনে প্রথমে মনস্থির করেছিলাম ইগ্নেশিয়ার  রোগী হবে। কিন্তু ওষুধ দেওয়ার আগেই  চোয়াল আটকে যাওয়াতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে তাৎক্ষণিক চোয়াল খোলার প্রত্যাশায় ইগ্নেশিয়া ৩০ শক্তির ঔষধ কয়েক ফোঁটা টিসু পেপারে নিয়ে  তা নিলুফার নাকের উপর দিয়ে রাখলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথমে নিলুফার চোখ নাড়াচাড়া করতেছে,  তার একটু পরেই চোখ খুলে গেল,  চোয়াল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। হাত দিয়ে ধরে দেখলাম চোয়ালের কাঠিন্যতা  আর নেই। চোখ খুলে  এদিক সেদিক দেখছিল। নাকের উপর ঔষধ প্রয়োগ করতে দেখে নিলুফার  সঙ্গীয় লোকজন হাসলে ও অল্পক্ষণের মধ্যে আরোগ্যর দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হলেন!  অবশেষে ইগ্নেশিয়া ওষুধ দিয়ে  নিলুফাকে বিদায়  করিলাম। 

প্যাথলজিক্যাল পরিক্ষা - নিরীক্ষায় রোগ পাওয়া না গেলেও অনেক ক্ষেত্রে কারণ এবং লক্ষণ  অনুসন্ধান পূর্বক চিকিৎসকগণ রোগের নামের  স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। ১৮৪০ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত চারশত  হিস্টিরিয়া রোগী নিয়ে  পল ব্রাকেট গবেষণা করেছিলেন। অতিতে মনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা হিস্টিরিয়া শব্দটি ব্যবহার করলেও  আধুনিক মনো চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা হিস্টিরিয়া শব্দটি ব্যবহার করতে চান না। কারণ হিস্টিরিয়া মানেই জরায়ুর ক্লেশ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন কিছু। 

 দীর্ঘদিন মানসিক চাপের কারণে ব্যাক্তির মাঝে শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। 

মানসিক সমস্যা ছাড়া ও দৈহিক  নানা সমস্যা যেমন,  রক্তচাপ,  হৃদস্পন্দন,  রক্তে সুগার বা ডায়াবেটিস বেড়ে  যাওয়া,  হাত পায়ের অসাড়তা দেখা দিতে পারে। 

রোগ সৃষ্টির কারণগুলো অপসারণ, রোগীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করিলে, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা থেকে  বিরত থাকিলে, পুষ্টিকর খাবার, নিয়মানুবর্তিতা, মাদক এড়িয়ে চলা, ধর্মীয় বিধিবিধান পালন করা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, কর্মব্যস্ত থাকা, দুঃখ-যাতনাগুলো আপনজন এবং  বন্ধুদের সাথে শেয়ার  করার মাধ্যমে হিস্টিরিয়া থেকে মুক্তিলাভ করা  যায়। 

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান হিস্টিরিয়া চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে না পারলে ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হিস্টিরিয়া প্রতিরোধে অনেকে কার্যকার  ঔষধ রয়েছে। যেহেতু হিস্টিরিয়া প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় আবিষ্কার সম্ভব নয় তাই হিস্টিরিয়া প্রতিরোধে কারণতত্ব ও  লক্ষ্মণ সাদৃশ্যের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা উৎকৃষ্ট ফল প্রদান করে থাকে। 

হিস্টিরিয়া চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য কিছু হোমিওপ্যাথি ঔষধের নাম দেওয়া হলো। 

রেজিস্টার্ড হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের তত্বাবধানে চিকিৎসা কার্য পরিচালিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। (চিকিৎসা স্মৃতি থেকে উপস্থাপন) 

হোমিওপ্যাথিক ওষুধের নাম 

এনাকার্ডিয়াম ওরি, অরাম মেটালিকাম, কোনিয়াম, ইগ্নেশিয়া , মস্কাস, নেট্রাম  মিউর,  নাক্স মস্কেটা, প্লাটিনা, পালসেটিলা,  সিপিয়া, ভেলেরিয়ানা, জিঙ্ক  ভেলেরিয়ানা, হায়োসিয়েমাস,  সিমিসিফিউগা, এসাফোটিডা,  ক্রোকাস স্যাটাইভা, ল্যাক ক্যান, স্ট্রামোনিয়াম, বেলাডোনা ইত্যাদি।

লেখক

ডা. এম. মোহসীন চৌধুরী 

হোমিওপ্যাথি মেডিসিন কনসালটেন্ট, সোনাগাজী পৌরসভা, ফেনী। 

Next Post Previous Post