ভালোবাসার এপিঠ-ওপিঠ!

 যদি বলতে যাই তবে সবথেকে সহজ এবং সর্বাধিক জটিল শব্দের কাতারে 'ভালোবাসা'। এরপর ভালোবাসি শব্দটিকে ঘিরেই যেন যত কৌতূহল। আর পৃথিবীর ঘূর্ণায়মান গতির পৃষ্টে এক সুপ্ত শান্তির ধ্বনি এই 'ভালোবাসা'। এর বিড়ম্বনাও আকাশচুম্বী। সহজ শব্দের জটিল ধাঁধাঁয় অনেক জ্ঞানী-গুণীই হয়েছেন বিকারগ্রস্থ, আবার কেওবা সমৃদ্ধ, কেউ কেউ হয়েছেন মহান।

একজন ভালোবেসে হাসে, অন্যদিকে কেউবা ফাঁসে। হাজার সমীকরণের ঊর্ধ্বে স্বমহিমায় দীপ্যমান এ ভালোবাসা। হাজারো না বলা কথার যোগফল এ অতিক্ষুদ্র বর্ণসমষ্টি। ব্যক্তি জীবনের সাফল্য বলুন কিংবা ক্ষতি পেছনের ইতিহাসটা শুধুই ভালোবাসা নির্ভর।

আর যদি আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে যাই, তবে এর মাপকাঠি কেবলই গভীর থেকে গভীরতর। তাই সৃষ্টির আদি থেকেই এই শৈল্পিক শব্দের মধুপানে পিছ পা হন নি কেওই! সেই সুমিষ্ট তরল কারো কারো কাছে কর্মফলযোগে রূপ নেয় গরলে। তাই তো উচ্চারিত হয়, 'মধু হই হই, আরে বিষ হাওয়াইলা।'

তবে ভালোবাসি এটি নির্ণয় করার নানান উপায় ও মাধ্যম নিজে থেকে বিশ্লেষণ করা গেলেও 'কেন ভালোবাসি' এই শব্দের সঠিক উত্তর নির্ণয় করাটা যেন খানিক অসাধ্য। ভালো না লাগার হাজারো কারণ থাকতে পারে কিন্তু ভালোবাসার জন্য একটি কারণই যথেষ্ট। ভালোবাসার প্রকারভেদ হয় নানাভাবে, যার প্রভাব সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায় সম্পর্কের বিভিন্নতায়। যেমনঃ একজন একুশ বছরের যুবক প্রেমিকার কাছে তার প্রেমিক অন্যদিকে মায়ের কাছে তার যক্ষের ধন। তাই বলা যায়, এই দুটি সম্পর্কে ভালোবাসার সরব উপস্থিতি তীব্রভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এখানে একটি শব্দের আপেক্ষিক মূল্যায়নে বিপরীত অর্থ এবং ভাবের উদয় ঘটায়।

তরুণী শাওনের মাঝবয়সী হুমায়ুন আহমেদ এর প্রেমে পড়ার কথা শুনে অনেকেই ভ্রু কুঁচকে উঠে।

আবার পথে ঘাটে অনেক সময় দেখা যায় অনেক সুন্দরী কোন এক মেয়ে খুব সাদামাটা কোন এক ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে।

সে দৃশ্য দেখে এরকম মন্তব্যও প্রায় শোনা যায়- "মেয়েটা সুন্দর, অথচ ছেলেটি দেখতে মোটেও ভাল না। এরকম একটা ছেলে এতো সুন্দর মেয়ে পায় কিভাবে?''

আমাদের চোখে কিছু ভালো লাগুক বা না লাগুক, সেটাতে আসলে কিছু যায় আসে না। মানুষের মন জিনিসটা আলাদা, বিশেষ করে নারীদের। তাদের সাইকোলজিও কিছুটা ভিন্ন।

রোমান্সের দিক থেকে ভাবলে বেশিরভাগ মেয়েই হয় ডেমিরোমান্টিক কিংবা স্যাপিওরোমান্টিক।

আবার যৌন আকর্ষণের দিক দিয়ে ভাগ করলে ডেমিসেক্সুয়াল কিংবা স্যাপিওসেক্সুয়াল।

কারো প্রতি মনের টান তৈরি হলে, তবেই তার প্রতি রোমান্টিক অনুভূতি তৈরি হয় বা প্রেম জেগে উঠে। এটাকে ডেমোরোমান্টিকতা বুঝায়।

আবার ডেমিসেক্সুয়াল ব্যাপারটা হল যে, যার প্রতি মনের টান থাকে, শুধু তার প্রতিই যৌন অনুভুতি তৈরি হয়।

মেয়েরা যে মানুষকে ভালোবাসে, পছন্দ করে, অনুভব করে, শুধু তার প্রতিই শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করে।

এর বাহিরে একজন পুরুষ যতই দেখতে সুদর্শন কিংবা ধনী হোক না কেন, তার প্রতি কোন যৌন আকর্ষণ কাজ করে না। নো মেন্টাল এটাচমেন্ট, নো ফিজিক্যাল এটাচমেন্ট।

স্যাপিওরোমান্স বা স্যাপিওসেক্সুয়াল ব্যাপারটা আবার একটু আলাদা। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য এর প্রতি আকর্ষিত না হয়ে তার বুদ্ধিমত্তা বা ইন্টেলেকচুয়ালিটির প্রতি প্রেমে পড়াকে স্যাপিওরোমান্স বলে।

বুদ্ধিমত্তা বা ইন্টেলেকচুয়ালিটির প্রতি মানুষের সবসময়ই প্রবল আকর্ষণ কাজ করে। ফলে কখনো না দেখলে কিংবা সামনাসামনি না থাকলেও শুধুমাত্র কারো বুদ্ধিমত্তা, চিন্তাভাবনা, ভাষণ, লেখা কিংবা জ্ঞানের গভীরতার কারণে তার প্রেমে পড়া সম্ভব। এই জিনিসটাই হল স্যাপিওরোমান্স।

আবার সেই বুদ্ধিমত্তার প্রতি প্রেম থেকে যে যৌন আকর্ষণ তৈরি হয়, সেটাকে স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি বলে।

এখানে চেহারা, শারীরিক গঠন, ফিগার নয়, কারো বুদ্ধিমত্তার কারণে তার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। সিক্স প্যাক বডি বা জিরো ফিগার এখানে সেক্সি কিছু নয়, হিয়ার ব্রেইন ইজ দ্য রিয়েল সেক্সি।

বাস্তবতা চিন্তা করলেও শারীরিক আকর্ষণ সাময়িক থাকে। যে মেয়েটি এখন বিশ্বসুন্দরী কিংবা যে ছেলেটি মি. ওয়ার্ল্ড, সেও এক সময় বুড়িয়ে যাবে, চামড়া কুঁচকে যাবে। সৌন্দর্য শেষ হয়ে যাবে, যৌবণও আর থাকবে না।

এ কারণে শরীর কেন্দ্রিক যেকনো অনুভুতি তৈরি হলে সেটা হয় অস্থায়ী। কিন্তু মনকেন্দ্রিক, অনুভুতিকেন্দ্রিক যে সম্পর্ক হয় তা স্থায়ী।

মনের টান তৈরি হলে শারীরিক টান তখন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। কিন্তু যেখানে শুধু সৌন্দর্যের টান বা শারীরিক টানই মুখ্য থাকে, সেটি ভালোবাসা নয়, সেটি হল কামনা।

ভালোবাসা শরীর নির্ভর কিছু নয়, এটি সম্পূর্ণ মন নির্ভর একটি অনুভুতি। দুটো শরীরের মিলন ভালোবাসা নয়, দুটো মনের মিলনই হল ভালোবাসা।

Next Post Previous Post