বিভিন্ন দার্শনিক গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা - ১। জড়বাদ বা বস্তুবাদ (Materialism), ২। ভাববাদ (Idealism), ৩। সত্ত্বাবাদ (Substantialism)।
(১) জড়বাদ বা বস্তুবাদ (Materialism) : জড়বাদ বা বস্তুবাদ হইল । এমন এক তত্ত্ববিদ্যক মতবাদ যাহা জড়কে বিশ্বজগতের আদি সত্ত্বা বলিয়া মনে করে। বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তু জড় বা পরমাণুর আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় এবং বিশ্ব জগত কতকগুলি যান্ত্রিক বা প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। মন বা আত্মা বলিয়া কোন আদি সত্ত্বা নাই। বরং মন ও প্রাণ জড়ের জটিলতর রূপমাত্র। জড়বাদ যান্ত্রিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাসী এবং যন্ত্রবাদের মুখপাত্র। জড়বাদীরা জীবনীশক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করিলে দেখা যায় বর্তমান এলোপ্যাথিক চিকিৎসকগণ সম্পূর্ণ জড়বাদের অন্তর্ভূক্ত। কেননা তাঁহারা নৈদানিক পরিবর্তন ও রোগজীবাণুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষণ ছাড়া রোগের অস্তিত্ব স্বীকার করেন, না। রোগ নির্ণয় ব্যাপারে মানসিক লক্ষণ তাঁদের কাছে মূল্যহীন। তাঁরা বিশ্বাস করেন যান্ত্রিক বিবর্তনের মাধ্যমে দৈহিক পরিবর্তন মানসিক লক্ষণে রূপান্তরিত হয়।
(২) ভাববাদ : ভাববাদের আলোচনার আওতায় এমন সব দার্শনিক মতবাদ পড়ে যেসব মতবাদ জগত প্রক্রিয়া নিরূপনের ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক বা অজড়াত্মক শক্তির কথা বলে। ভাববাদীদের মতে বিশ্বজগত মনের উপর নির্ভরশীল, মনের ধারণা ছাড়া ইহা অন্য কিছুই নয়। ভাববাদের মূল বক্তব্য মন নিরপেক্ষ কোন সত্ত্বা নাই। ঝাড়, ফুঁক, পানিপড়া, তাবিজ দিয়া চিকিৎসার চিকিৎসকগণকে ভাববাদের অন্তর্ভূক্ত বলা যায়। তাহাদের বিশ্বাস কতকগুলি রোগ আছে যাহাদিগকে বলা হয় আসমানী বালা। এগুলি ঔষধ দিয়া আরোগ্য করা যায় না। আধ্যাত্মিক বলে এগুলি আরোগ্য করা সম্ভব।
ভাববাদ আব দুই প্রকার। যথা
ক) আত্মগত ভাববাদ (Subjective Idealism)।
খ) বস্তুগত ভাববাদ (Objective Idealism)
ক) আত্মগত ভাববাদ : বার্কলি এই ভাববাদের প্রবর্তক। তাঁহার মতে জড়বাদের সঙ্গে নিরীশ্বরবাদ ও সংশয়বাদ অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিনি মনে করেন জড়ের কোন অস্তিত্ব নাই। জগতের সবকিছুই মনের ভাব বা ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। মনে ধারণা করিলেই জড়জগত অস্তিত্বশীল, নতুবা নয়।
খ) বস্তুগত ভাববাদ ও হেগেল এই মতবাদের প্রবর্তক। তাঁহার মতে বিশ্বজগত পরমাত্মার এক মনন বা চিন্তন প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। সমগ্র বিশ্বজগতই একটি মনন প্রক্রিয়া। জড় ও মন, বস্তু ও আত্মা, সসীম ও অসীমের মধ্যে কোন পার্থক্য করা উচিত নয়। পরমাত্মা জগতের বিভিন্ন বস্তুর মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। স্রষ্টার বিকাশ সৃষ্টির মধ্য দিয়াই হইয়া থাকে।
(৩) সত্বাবাদ (Substantialism) : সত্ত্বাবাদের অন্য অর্থ হইল প্রাণবাদ। সত্ত্বাবাদের মূল কথা হইল বিশ্বপ্রকৃতির সবকিছুই সত্য। জড় পদার্থ যেমন সত্য, অজড় মনও তেমনি সত্য। প্রাণ জড়শক্তি হইতে উদ্ভুত হয় না, প্রাণ জড়দেহকে আশ্রয় করিয়া নিজেকে বিকশিত করে। জড় ও অজড় উভয়ই বাস্তব সত্ত্বা হইতে উদ্ভুত হইয়াছে। এই হিসাবে জীবন, আত্মা, শব্দ, গন্ধ, আলো, বাতাস, শক্তি যাহা দেখা যায় বা দেখা যায় না সব কিছুরই সত্ত্বা আছে। জীবদেহ ও আত্মা সবকিছুই বস্তু।